মেট্রোরেলঃ উত্তরা আবাসিক এলাকার ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনা
মেট্রোরেল প্রকল্প বাংলাদেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মাঝে একটি। এই রেলে চড়ে মতিঝিল থেকে উত্তরা মডেল টাউনে পোঁছা যাবে মাত্র ৩১ মিনিটে। প্রকল্পটির প্রারম্ভিক স্টেশন উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজে অবস্থিত। বর্ধিত এ অংশটি বাংলাদেশের সুপরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গুলোর মাঝে একটি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবাসন সমস্যা নিরসনে প্রকল্পটি গড়ে তোলা হলেও মেট্রো রেল প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ পাল্টে দিচ্ছে; এলিট শ্রেণীর নিকটও প্রকল্পটি এখন সমান জনপ্রিয়।
উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ ইতোমধ্যে দিয়াবাড়ি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এ এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠছে নতুন নতুন অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের আকর্ষণ বাড়ছে এ প্রকল্পে। অর্থাৎ মেট্রোরেল এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচন করতে যাচ্ছে।
একনজরে মেট্রোরেল
জনবহুল ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান পরিবহন সংকট ও দুঃসহ যাটজট নিরসন কল্পে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্মানাধীন শহর ভিত্তিক রেল ব্যবস্থার নাম হচ্ছে মেট্রো রেল যা অফিসিয়াল ভাবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ প্রকল্পটি ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। একনজরে মেট্রোরেল-
- রুটঃ উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ-পল্লবী-রোকেয়া সরণির পশ্চিম পাশ দিয়ে (চন্দ্রিমা উদ্যান-সংসদ ভবন) খামারবাড়ী হয়ে ফার্মগেট-সোনারগাঁও হোটেল-শাহবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বর-তোপখানা রোড থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত।মোট ২০. ১ কিলোমিটার।
- প্রকল্প ব্যয়ঃ ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লক্ষ টাকা, প্রকল্প ব্যায়ের ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা অর্থ সহায়তা হিসেবে জাইকা প্রদান করবে।(বর্তমান হিসেব অনুযায়ী ব্যয় হবে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা যা ১৯ জুলাই ২০২২ ইং তারিখে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়) নির্মাণ কাজের উদ্বোধনঃ ২০১৬ সালের ২৬ জুন।
- আনুষ্ঠানিক নির্মাণ কাজ শুরুঃ ২০১৭ সালের ২ আগস্ট ।
- নির্মাণ প্রতিষ্ঠানঃ ইটালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানী (ইটাল-থাই) ও চায়না সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড জেভি।
- মোট স্টেশনঃ ১৬টি। স্টেশনগুলো তিন তলা উচ্চতার, দ্বিতীয় তলায় টিকেট কাউন্টার সহ অন্যান্য সুবিধাদি থাকবে, আর প্ল্যাটফর্ম হবে তৃতীয় তলায়। টিকেট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের ব্যবস্থা থাকবে স্বয়ংক্রিয়।
- ট্রেনের সংখ্যাঃ প্রাথমিক অবস্থায় ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে।
- যাত্রী পরিবহনঃ দুদিক থেকে ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে।
- বিদ্যুৎঃ ট্রেন গুলো বিদ্যুৎ চালিত হওয়ায় ঘন্টায় ১৩৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে যা জাতীয় গ্রীড থেকে নেয়া হবে। এর জন্য ৫টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থাকবে।
- উত্তরা থেকে মতিঝিল পোঁছাতে সময় লাগবে ৩১ মিনিট।
- ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ হতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও এ রুটে মেট্রো রেল চলাচল করবে। ১২ ডিসেম্বর ২০২১ সালে এ অংশে পরীক্ষামূলক চলাচল সম্পন্ন করেছে।
- সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৫ সালে মেট্রো রেলের কাজ পুরোপুরি শেষ হবার কথা ।
উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ
ঢাকা শহরের উত্তরে অবস্থিত অত্যন্ত সু-পরিকল্পিত কোলাহল ও দূষণমুক্ত এলাকা উত্তরা মডেল টাউন। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবাসিক সমস্যা নিরসনে গড়ে তোলা হলেও সময়ের ব্যবধানে এটি অভিজাত অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করার পর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সাথে আবাসন সংকটের সমন্বয় করার জন্য রাজউক এ এলাকাকে বর্ধিত করণকল্পে থার্ড ফেইজের কাজে হাত দেয়। এর জন্য ২১৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। একনজরে বর্ধিত থার্ড ফেজ-
- অবস্থানঃ উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ জিরো পয়েন্ট থেকে ২০ কি. মি. (প্রায় ১২ মেইল) দূরে অবস্থিত। প্রকল্পটি উত্তরা মডেল টাউন দ্বিতীয় প্রকল্পের পশ্চিমে অবস্থিত। প্রকল্পটি দক্ষিণে মিরপুর সেনানিবাস এবং পশ্চিমে মিরপুর-আশুলিয়া বেড়ি বাঁধ দ্বারা সীমাবদ্ধ।
- সেক্টরঃ ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নং সেক্টরের সমন্বয়ে প্রকল্পটি গঠিত হয়।
- ফ্লট ১০০০০ টি, ফ্লট ২২৫৫১২টি ।
- প্রকল্প ব্যয়ঃ ২৩.১৬ বিলিয়ন টাকা।
- প্রকল্পের মেয়াদঃ জুন ২০২২ এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবার কথা।
- মেট্রো রেলের প্রারম্ভিক স্টেশন উত্তরার এ অংশে অবস্থিত।
- পুরো প্রকল্পের ৫৫% জায়গা খেলার মাঠ, পার্ক, লেক, সবুজ বনায়ন ও রাস্তার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
- বাস্তবায়কারী সংস্থাঃ রাজউক।
অনন্য উচ্চতায় ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা
মেট্রোরেল মাত্র ৩১ মিনিটে পোঁছে দিবে উত্তরা থেকে মতিঝিল, প্রতিদিন অনিশ্চিত সময়ের সাথে যুদ্ধ করা ঢাকাবাসীর জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? ঘন্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণে সক্ষম এ রেল চালু হলে ঢাকার যানযট অনেকাংশেই কমে গিয়ে এ শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনন্য উচ্চতায় পোঁছে যাবে বলে আশা করা যায়।
আবাসন শিল্পের অপার সম্ভাবনা
অপরিকল্পিত নগরায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভয়াবহ দূষণ, তীব্র যানযট ও অন্যান্য নাগরিক বিড়ম্বনায় ঢাকার মূল অংশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে আগেই, আশেপাশে সৃষ্ট পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গুলো ও বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে। এমতাবস্থায় দিন শেষে শান্তি খোঁজা মানুষ গুলোর হাহাকার বাড়ছে। আশার আলো দেখাচ্ছে মেট্রো রেল।
মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার মূল অংশে অফিস করা মানুষগুলো অতি অল্প সময়েই উত্তরা থেকে যাতায়াত করতে পারবে। তাই দিন শেষে শান্তি খোঁজা মানুষ গুলো নতুন আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ কে। ফলে এ অঞ্চলের আবাসন চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে এ শিল্পের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এশিউর গ্রুপ সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নতুন প্রল্পের জন্য এ এলাকাকেই বেছে নিচ্ছে।
নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি
এইতো কয়েক বছর আগেই উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ একটি ভুতুড়ে এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিলো। মেট্রো রেল প্রকল্প শুরু হবার পর থেকে এ এলাকার গুরুত্ব হু হু করে বেড়ে চলেছে। রাজউক এপার্টমেন্ট প্রজেক্ট ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে বরাদ্দ প্রাপ্ত ফ্লট গুলোতে গড়ে উঠছে সুরম্য আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এ এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে অনেক অফিস। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান। আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল কাছাকাছি দুরত্বে অবস্থিত হবার কারনে পুরো এ অংশ জুড়ে কর্মচঞ্চলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
পর্যটন শিল্পের বিকাশ
দিয়াবাড়ি! দূষিত ঢাকার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পর্যটন কেন্দ্র। নির্মল, প্রাণ চঞ্চল ও পরিচ্ছন্ন এ জায়গায় প্রতিদিন ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের জেলা থেকে হাজারও মানুষ ঘুরতে আসে। এখানে রয়েছে শিশু ও পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র, সেক্টর পার্ক সহ অবারিত কাশের প্রান্তর।
দিয়াবাড়ি কী পরিকল্পিত বিনোদন কেন্দ্র? না, এটি পরিকল্পিত কোন বিনোদন কেন্দ্র নয়; এটি আসলে উত্তরা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ আবাসিক এলাকা। পরিকল্পিত এ আবাসিক এলাকা এতোটা সুসজ্জিত করে সাজানো হয়েছে যে, এটি প্রাকৃতিক বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে যা ইতোমধ্যে দিয়াবাড়ি পর্যটন কেন্দ্র নামে ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে। মেট্রোরেল চালু হলে এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হবে বলে আশা করা যায়।
সারসংক্ষেপ
উত্তরা আবাসিক এলাকা (বর্ধিত) থার্ড ফেজ একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক প্রকল্প। মেট্রো রেলে চড়ে মতিঝিল থেকে এখানে পোঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৩১ মিনিট। যানযটে নাকাল নগরবাসী এতোদিন অসনীয় কষ্ট সহ্য করে ঢাকার মূল অংশে থাকতে বাধ্য হলেও মেট্রো রেল পরিস্থিতি পাল্টে দিচ্ছে, বসবাসের জন্য এখন অনেকেই বেছে নিচ্ছে সবুজে ঘেরা উত্তরার এ অংশ কে। অর্থাৎ মেট্রো রেল বদলে দিচ্ছে এ আবাসন প্রকল্পের ভবিষ্যৎ, খুলে দিচ্ছে আবাসন, পর্যটন ও অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার।